ডেস্ক রিপোর্ট:
ফুটবল বিশ্বে দিয়েগো ম্যারাডোনা ছিলেন অনন্য। ক্রীড়াঙ্গনের বাইরেও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে তিনি ছিলেন সমাদৃত। আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর নিপীড়ন ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সবসময় আওয়াজ তুলতেন। সেই সুবাদে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ কিংবা বলিভিয়ার ইভো মোরালেসের মতো বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে তার ছিল গভীর বন্ধুত্ব। কারণ তাদের ভিতরে ম্যারাডোনা খুঁজে পেতেন প্রতিরোধের স্পর্ধা। আর ঠিক সেই স্পর্ধাই তিনি বারবার দেখিয়েছিলেন ফিলিস্তিনের প্রশ্নে।
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর, আচমকা না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ম্যারাডোনা। তার মৃত্যুর খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শুধু আর্জেন্টিনা নয়, শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল ফিলিস্তিনও। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর শোকবার্তা এসেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই ভূখণ্ড থেকেও। ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক সংগঠন হামাসের তৎকালীন মুখপাত্র সামি আবু জুহরি টুইটারে লেখেন, ‘আমরা গভীরভাবে শোকাহত, কারণ ম্যারাডোনা ছিলেন সেই কণ্ঠস্বর, যিনি ফিলিস্তিনের ন্যায্য আন্দোলনকে সমর্থন জানাতেন।’
বছরের পর বছর ধরে বর্বরতা চালানো দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী যেন এবার মরণকামড় দিয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়। নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে দখলদাররা। প্রতিদিনই বড় হচ্ছে লাশের মিছিল। বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। যখন গাজা আবারও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, যখন ইসরায়েলি হামলায় কাঁপছে একটি জাতি—তখন আরও একবার মনে পড়ে যাচ্ছে ম্যারাডোনার কথা। সেই মানুষটি, যিনি হৃদয়ের গভীর থেকে ফিলিস্তিনকে অনুধাবন করতেন। একবার বলেছিলেন, ‘আমার হৃদয়ে আমি ফিলিস্তিন।’
২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা নিজেকে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের সবচেয়ে বড় ভক্ত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে আর্জেন্টাইন প্রয়াত এই কিংবদন্তি বলেছিলেন, ‘আমি তাদের শ্রদ্ধা করি এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করি। আমি কোনো ভয় ছাড়া ফিলিস্তিনকে সমর্থন করি।’ এর দুই বছর পর গাজায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দখলদার ইসরায়েল। যাতে অন্তত তিন হাজার ফিলিস্তিনি মারা যায়। এ ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলেন ম্যারাডোনা। এক বিবৃতিতে সে সময় তিনি বলছিলেন, ‘ইসরায়েল যা করছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।’
শুধু মুখের কথা নয়, ম্যারাডোনার কার্যক্রমেও ছিল সেই দায়বদ্ধতা। ২০১৫ সালে এএফসি এশীয় কাপের সময় ফিলিস্তিনি জাতীয় দলকে প্রশিক্ষণ দিতে ফিলিস্তিনি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তার আলোচনার গুঞ্জনও শোনা গিয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে রাশিয়ায় বিশ্বকাপ চলাকালে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি বলেন, ‘আমার হৃদয়ে, আমি ফিলিস্তিন।’ সেই মুহূর্তের ভিডিওটা এখনও ঘুরে বেড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, প্রমাণ রেখে যায় যে কিছু ভালোবাসা রাজনীতির গণ্ডি ছাপিয়ে যায়।
এমনকি সিরিয়া ইস্যু বা ইরাক যুদ্ধ নিয়েও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন তিনি। একাধিকবার দেখা গেছে অ্যান্টি-জর্জ বুশ টি-শার্ট গায়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে। তার মতো বিশ্বখ্যাত একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এসব বার্তা ছিল সাহস ও মানবতার অনন্য উদাহরণ। আজ ফিলিস্তিন যখন আগুনে জ্বলছে, তখন ভাসছে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির কথা, যিনি পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে ভালোবেসেছিলেন একটি মুক্তিকামী জাতিকে। হয়তো তিনি আর নেই, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর—’আমি ফিলিস্তিনি’। এখনও গাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ভেসে আসে প্রতিবাদের গান হয়ে।
সূত্র : আল-জাজিরা।
Leave a Reply